পবিত্র শবে বরাত প্রসঙ্গে উলামায়ে ছূদের আপত্তির জবাব, পর্ব-১

উলামায়ে ‘ছূ’রা ‘শবে বরাত’ সম্পর্কে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। উলামায়ে ‘ছূ’ বা ধর্মব্যবসায়ীরা বলে ও প্রচার করে থাকে যে, শবে বরাত কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর কোথাও নেই, শবে বরাত পালন করা বিদয়াত, নাজায়িয ও হারাম। নাঊযুবিল্লাহ!
তাদের এ বক্তব্যের কারণে তারা নিজেরা যেরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তদ্রুপ তাদের উক্ত কুফরীমূলক বক্তব্য ও বদ আমলের কারণে সাধারণ মুসলমানগণ ই’তিক্বাদী বা আক্বীদাগত ও আ’মালী বা আমলগত উভয় দিক থেকেই বিরাট ক্ষতির সম্মুক্ষীন হচ্ছে। কেননা কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে শবে বরাতের অশেষ ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। তাই এ সকল ধর্মব্যবসায়ীদের মুখোস উম্মোচন করে সঠিক বিষয়টা তুলে ধরার প্রয়াস পাবো। ইনশা আল্লাহ।
শবে বরাতের অশেষ ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন এ প্রসঙ্গে বর্ণিত রয়েছে-
ان الدعاء يستجاب فى خمس ليال اول ليلة من رجب وليلة النصف من شعبان وليلة القدر المباركة وليلة العيدين
অর্থ: “নিশ্চয়ই পাঁচ রাত্রিতে দোয়া নিশ্চিতভাবে কবুল হয়ে থাকে। (১) রজব মাসের প্রথম রাতে, (২) শবে বরাতের রাতে, (৩) ক্বদরের রাতে, (৪) ঈদুল ফিতরের রাতে, (৫) ঈদুল আযহার রাতে।” (সুনানুল কবরা লি বায়হাকী ৩/৩১৯)
ধর্মব্যবসায়ীরা বলে থাকে কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফে কোথাও শবে বরাত শব্দ উল্লেখ নাইঃ
‘শবে বরাত’ ফারসী ভাষায় ব্যবহার হয় শব অর্থ হচ্ছে রাত, এবং বরাত অর্থ হচ্ছে ভাগ্য, বরকত, নাজাত ইত্যাদি। এককথায়দ যার বাংলায় অর্থ হচ্ছে ভাগ্যরজনী বা মুক্তির রাত।
কুরআন শরীফ-এ রয়েছে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম-উনার নাম মুবারক যা ছুরইয়ানী ভাষার অন্তর্ভুক্ত। হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালাম, হযরত দাউদ আলাইহিস্ সালাম ও হযরত মুসা আলাইহিস্ সালাম-উনাদের নাম মুবারক যা হিব্রু ভাষার অন্তর্ভুক্ত। এরূপ শব্দ মুবারক যা আরবী নয় বরং অনারবী তথা আরবী ও আজমী’র সংমিশ্রণে পবিত্র কুরআন শরীফ। তবে আরবী সংখ্যাধিক্য হওয়ার কারণে আরবী।
অনুরূপভাবে হাদীছ শরীফেও আল্লাহ পাক-উনার হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং নিজে আরবী ও অনারবী ভাষা ব্যবহার করেছেন। তদ্রুপ আওলিয়ায়ে কিরাম উনারা ওইরূপ ভাষা ব্যবহার করেছেন এবং স্থান, কাল, পাত্র, পরিবেশ ও অঞ্চল ভেদে মূল বিষয় তথা একই বস্তু ও জিনিস এর মূল ভাব ঠিক রেখে একই অর্থে তা বিভিন্ন ভাষায় ব্যবহার হয়ে থাকে। এটা জায়িয তো বটেই বরং ক্ষেত্র বিশেষে সুন্নাতুল্লাহ, সুন্নাতে রসূলুল্লাহ ও সুন্নাতুল আওলিয়া এবং সুন্নতুল আউয়ালীন ওয়াল আখিরীন।
এর অসংখ্য ও অগণিত উদাহরণ রয়েছে। নিম্নে কয়েকটি উদাহরণ বর্ণনা করা হলো-
যেমন, ‘ছলাত’ শব্দটি আরবী। যা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত পাঁচবার পড়া প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য (শর্ত সাপেক্ষে) ফরয। ‘ছলাত’ শব্দটিকে ফারসী ভাষায় বলা হয় ‘নামায।’ উর্দূতেও নামায বা ‘বন্দিগী।’ বাংলায় ‘প্রার্থনা।’ ইংরেজিতে চৎধুবৎ (প্রেয়ার)। আরো অন্যান্য ভাষাভাষীর লোকেরা অন্যান্য ভাষায় ‘ছলাত’ শব্দকে বুঝিয়ে থাকে যার মূল ভাব, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন।
অনুরূপভাবে ‘রোযা’ শব্দটি ফারসী। আরবীতে বলা হয় ‘ছিয়াম।’ ইংরেজীতে বলে ঋধংঃরহম (ফেসটিং) বাংলায় আমরা বলে থাকি অভূক্ত থাকা, পানাহার ও গুনাহ থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি। যার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। কিন্তু বিভিন্ন ভাষায় ব্যবহার হলেও সকল ভাষার মূল বিষয় হচ্ছে ‘ছিয়াম।’
অনুরূপভাবে معراج (মি’রাজ) এর রাত্রিকে আরবীগণ বলে থাকেন, ليلة المعراج (লাইলাতুল মি’রাজ) বা ليلة الاسراء (লাইলাতুল আসরা)
ফরাসীগণ ফারসী ভাষায় এটাকেشب معراج (শবে মি’রাজ) বলে থাকেন। উর্দূতে معراج كى ليل (মি’রাজ কী লাইল) বাংলায় যার অর্থ হচ্ছে ঊর্ধ্বগমনের রাত। একইভাবে ক্বদরের রাতকে আরবীতে ليلة القدر ফারসীতে শবে ক্বদর বলা হয়।
তদ্রƒপ ‘শবে বরাত’ ফারসী ভাষায় ব্যবহার হয় যার বাংলায় অর্থ হচ্ছে ভাগ্যরজনী বা মুক্তির রাত। আরবীতে শবে বরাতের বহু নাম রয়েছে যা বিশ্ববিখ্যাত হাদীছ শরীফ-এর কিতাবে এবং সর্বজনমান্য তাফসীর ও ফিক্বাহর কিতাবসমূহে উল্লেখ হয়েছে। যেমন-
কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, তাফসীর ও ফিক্বাহর কিতাবে বর্ণিত ‘শবে বরাত’-এর অন্যান্য নামসমূহঃ
(১) الليلة المباركة (আল্লাইলাতুল মুবারকাতু) বরকতময় রজনী।
(২) ليلة النصف من شعبان (লাইলাতুন্ নিছফি মিন শা’বানা) অর্ধ শা’বানের রজনী।
(৩) ليلة القسمة (লাইলাতুল ক্বিস্মাতি) ভাগ্য রজনী।
(৪) ليلة التكفير (লাইলাতুত্ তাকফীরি) গুনাহ্খতা ক্ষমা বা কাফ্ফারার রাত্রি।
(৫) ليلة الاجابة (লাইলাতুল ইজাবাতি) দোয়া কবুলের রাত্রি।
(৬) ليلة الحياة (লাইলাতুল হায়াতি) হায়াত বা আয়ু বৃদ্ধির রাত্রি।
(৭) ليلة عيد الملائكة (লাইলাতু ঈদিল্ মালায়িকাতি) ফেরেশতাগণের ঈদের রাত্রি।
(৮) ليلة البراءة (লাইলাতুল বারাআতি) মুক্তির রাত্রি বা ভাগ্য বন্টনের রাত।
(৯) ليلة التجويز (লাইলাতুত্ তাজবীযি) বিধান সাব্যস্ত করার রাত্রি।
(১০) ليلة الفيصلة (লাইলাতুল ফায়সালাতি) সিদ্ধান্ত নেয়ার রাত্রি।
(১১) ليلة الصك (লাইলাতুছ্ ছক্কি) ক্ষমা স্বীকৃতি দানের রাত্রি।
(১২) ليلة الجاءزة (লাইলাতুল জায়িযাতি) মহা পুরস্কারের রাত্রি।
(১৩) ليلة الرجحان (লাইলার্তু রুজহানি) পরিপূর্ণ প্রতিদানের রাত্রি।
(১৪) ليلة التعظيم (লাইলাত্ত্ ুতা’যীমি) সম্মান হাছিলের রাত্রি।
(১৫) ليلة التقدير (লাইলাতুত্ তাক্বদীরি) তক্বদীর নির্ধারণের রাত্রি বা ভাগ্য নির্ধারণের রাত।
(১৬) ليلة الغفران (লাইলাতুল গুফরানি) ক্ষমাপ্রাপ্তির রাত্রি।
(১৭) ليلة العتق من النار (লাইলাতুল ইত্ক্বি মিনান্ নীরানি) জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার রাত্রি।
(১৮) ليلة العفو (লাইলাতুল আফবি) অতিশয় ক্ষমা লাভের রাত্রি।
(১৯) ليلة الكرام (লাইলাতুল কারামি) অনুগ্রহ হাছিলের রাত্রি।
(২০) ليلة التوبة (লাইলাতুত্ তাওবাতি) তওবা কবুলের রাত্রি।
(২১) ليلة الندم (লাইলাতুন্ নাদামি) কৃত গুনাহ স্মরণে লজ্জিত হওয়ার রাত্রি।
(২২) ليلة الذكر (লাইলাতুয্ যিকরি) যিকির-আযকার করার রাত্রি।
(২৩) ليلة الصلوة (লাইলাতুছ্ ছলাতি) নামায আদায়ের রাত্রি।
(২৪) ليلة الصدقة (লাইলাতুছ্ ছদাক্বাতি) দানের রাত্রি।
(২৫) ليلة الخيرات (লাইলাতুল খইরাতি) নেক কাজ সম্পাদনের রাত্রি।
(২৬) ليلة انزال الرحمة (লাইলাতু ইনযালির রহ্মাতি) রহমত নাযিলের রাত্রি।
(২৭) ليلة صلوة وسلام على سيد المرسلين صلى الله عليه وسلم (লাইলাতু ছলাতিন ওয়া সালামিন আলা সাইয়্যিদিল মুরসালীনা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাইয়্যিদুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার প্রতি ছলাত ও সালাম পাঠের রাত্রি ইত্যাদি।
এছাড়াও ‘শবে বরাতের’ আরো অনেক নাম রয়েছে। যা এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হয়নি।
কুরআন শরীফ-এর সূরা আদ দুখানের আয়াত শরীফ এ লাইলাতুল বরাতকে অনেকে অস্বীকার করে লাইলাতুল ক্বদর বলতে চায়। তাদের বক্তব্যের জবাবঃ
শবে বরাত বা ভাগ্য রজনীকে স্বয়ং আল্লাহ পাক স্বীয় কুরআন শরীফ-এ সূরা ‘আদ দোখান’ এর ৩-৪ নম্বর আয়াত শরীফে ليلة المبارك (বরকত পূর্ণ রাত) হিসেবে উল্লেখ করে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন-
انا انزلناه فى ليلة مباركة انا كنا منذرين. فيها يفرق كل امر حكيم
অর্থ: “নিশ্চয়ই আমি উহা (কুরআন শরীফ) এক রবকতপূর্ণ রাত্রিতে নাযিল করেছি। অর্থাৎ নাযিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী, ওই রাত্রিতে সমস্ত হিকমতপুর্ণ কাজসমূহের বণ্টন করা হয় তথা বণ্টনের ফায়সালা করা হয়।” (সূরা আদ দোখান-৩-৪)
উক্ত আয়াত শরীফ-এ বর্ণিত ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ দ্বারা অনুসরনীয় মুফাসসিরীনে কিরাম উনারা শবে বরাতকেই বুঝিয়েছেনঃ
قال عكرمة هى ليلة النصف من شعبان يبرم فيه امر السنة وينسخ الاحياء من الاموات فلا يزاد فيهم ولا ينقص منهم احد. روى البغوى عن محمد بن الميسرة بن الاخفس ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال يقطع الاجال من شعبان الى شعبان حتى ان الرجل لينكح و يولد له ولقد اخرج اسمه فى الموتى.
وروى ابو الضحى عن ابن عباس ان الله يقضى الاقضية فى ليلة النصف من شعبان ويسلمها الى اربابها فى ليلة القدر.
অর্থ: “প্রখ্যাত ছাহাবী হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, (সূরা আদ দুখানের ৩ নম্বর আয়াত শরীফ) ليلة مباركة হচ্ছে ১৫ই শা’বানের রাত তথা শবে বরাতের রাত। এ রাত্রে সারা বৎসরের কাজ কর্মের ফায়ছালা করা হয় এবং কতজন জীবিত থাকবে ও কতজন মারা যাবে তারও ফায়ছালা করা হয়। অতঃপর এ ফায়ছালার থেকে কোন কিছু বেশি করা হয় না এবং কোন কমতিও করা হয় না। অর্থাৎ কোন প্রকারের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয় না। হযরত ইমাম বাগবী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বর্ণনা করেছেন, হযরত মুহম্মদ ইবনে মাইসারা ইবনে আখফাশ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার থেকে। তিনি বলেন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, শা’বান মাসে পরবর্তী শা’বান মাস পর্যন্ত মৃত্যুর ফায়ছালা করে দেয়া হয়। এমনকি লোকেরা যে বিবাহ করবে, সেই বৎসর তার থেকে কত জন সন্তান জন্মগ্রহন করবে তার তালিকা এবং তার মৃত্যুর তালিকাও প্রস্তুত করা হয় ওই বৎসরে অর্ধ শাবানের রাতে তথা শবে বরাতে।
আবুদ্বহা এর বর্ণনায় এসেছে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা তিনি বলেন, শা’বানের মাঝামাঝি অর্থাৎ ১৫ই শা’বানের রাতে তথা শবে বরাতে আল্লাহ পাক সমস্ত কিছুই ফায়ছালা করেন, আর রমাদ্বানের ক্বদর রাতে (শবে ক্বদরে) সেই ফায়ছালার তালিকা (কপি) বাস্তবায়ন করার জন্য বাস্তবায়নকারীদের কাছে অর্পণ করা হয়। (তাফসীরে মাযহারী এর ৮ম খন্ড ৩৬৮ পৃষ্ঠা)
তাফসীরের কিতাবে আরো উল্লেখ আছে-
(انا انزلناه فى ليلة مباركة).. وقيل هى ليلة النصف من شعبان
অর্থ: “নিশ্চয়ই আমি এক বরকতময় রাত্রিতে উহা অর্থাৎ পবিত্র কুরআন শরীফ অবতীর্ণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে লাইলাতুম মুবারাকা দ্বারা অর্ধ শা’বান তথা ১৫ই শা’বানের রাতকে (শবে বরাত) উল্লেখ করা হয়েছে। (তাফসীরুল খাযিন এর ৪র্থ খ-ের ১১২ পৃষ্ঠায়)
বিশ্বখ্যাত তাফসীর তাফসীরে মাদিরক-এ ليلة المباركة এ আয়াতাংশের তাফসীরে উল্লেখ আছে-
وهذه الليلة مفرق كل أمر حكيم ومعنى يفرق يفصل ويكتب كل أمر من ارزاق العباد واجالهم وجميع أمورهم من هذه الليلة الى ليلة القدرالتى تجى فى السنة المقبلة
অর্থ: ليلة مباركة (লাইলাতুম মুবারাকাহ) দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্ধ শা’বানের রাত তথা শবেবরাত এবং এই মুবারকময় রাতে সকল প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়সমূহের ফায়ছালা করা হয়। আয়াত শরীফ-এর يفرق শব্দের অর্থ হচ্ছে يفصل (ইউফাছছালু) তথা ফায়ছালা করা, এবং يكتب (ইউকতাবু) তথা লেখা হয় প্রত্যেক বান্দাদের রিযিক বা জীবিকাসমূহ। তাদের মৃত্যুর সময় সীমাও লেখা হয় এবং সমস্ত বিষয়ের তালিকা লেখা হয় এই মুবারক রাতে তথা শবে বরাতে। আর ক্বদর রাতে তথা মর্যাদাবান রাতে ওই সমস্ত ফায়ছালাকৃত বিষয়গুলো চালু করা হয় তথা কার্যকরী করা হয় যা সামনের এক বৎসর পর্যন্ত চলতে থাকে। (তাফসীরু হাশিয়াতিল খাযিন ৪র্থ খ-,পৃঃ ১১২)
উল্লেখ্য যে, যদিও কেউ কেউ ليلة مباركة দ্বারা ليلة القدر বুঝে থাকেন মূলত তা নয়, বরং ليلة القدر দ্বারা শবে বরাতের সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন বা কার্যকরী করার রাতকে বুঝানো হয়েছে।
যেমন এ প্রসঙ্গে সূরা ক্বদরের তাফসীরে, উল্লেখ আছে-
فقيل له (للحسين بن الفضل) فما معنى ليلة القدر قال سوق المقادير الى المواقيت وتنفيذ القضاء المقدر.
অর্থ: “হযরত হুসাইন ইবনে ফযল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে জিজ্ঞাসা করা হল ‘লাইলাতুল ক্বদর’-এর অর্থ কি? তিনি উত্তরে বলেন, পূর্বে স্থিরীকৃত সিদ্ধান্তসমূহ নির্ধারিত সময়ের দিকে পরিচালনা করা এবং পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্তের যথার্থ বাস্তবায়ন করাই হচ্ছে ক্বদর রাতের অর্থ।”
কাজেই উল্লিখিত দলীলের ভিত্তিতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল যে, অর্ধ শা’বানের রাত হচ্ছে ليلة التجويز তথা বণ্টনের বা সিদ্ধান্তের রাত। আর লাইলাতুল ক্বদর হচ্ছে ليلة التنفيذ তথা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের রাত। (তাফসীরে খাযিন ৪র্থ খ-ের ৩৯০ পৃষ্ঠা)
আদ দুখানের এই আয়াত শরীফ-এর ব্যাখ্যায় একইভাবে শবে বরাতের রাতকেই বুঝানো হয়েছে। যেমন উল্লেখ আছে-
وقال عكرمة رضى الله تعالى عنه هى ليلة النصف من شعبان يبرم فيها امر السنة وتنسخ الاحياء من الاموات فلايزاد فيهم احد ولا ينقص منهم احد.
অর্থ: “হযরত ইকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, লাইলাতুম মুবারাকা এবং ফায়ছালার রাত দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্ধ শা’বান এর (১৫ই-শাবানের) রাত তথা শবে বরাত। আর এই শবে বরাতের রাতে সামনের এক বৎসরের যাবতীয় বিষয়ের ভাগ্যলিপি প্রস্তুত করা হয়। এবং জীবিত ও মৃত্যুদের ভাগ্য তালিকাও প্রস্তুত করা হয় এই শবে বরাতে। অতঃপর ওই ভাগ্য তালিকা থেকে কোন কম বেশি তথা হেরফের করা হয় না। (তাফসীরে বাগবী এর ৬ষ্ঠ খ-ের ১৪৩ পৃষ্ঠা)
এ প্রসঙ্গে “তাফসীরে নাযমুদ দুরার” কিতাবের ৭ম খ-ের ৬২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
او ليلة النصف من شعبان
অর্থ: “লাইলাতুম মুবারাকা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্ধ শা’বানের রাত তথা ১৫ই শা’বানের রাত।”
উক্ত তাফসীরে আরো উল্লেখ আছে-
قال وروى ابو الضحى عنه ان الله تعالى يقضى الاقضية فى ليلة النصف من شعبان فيسلمها الى اربابها فى ليلة القدر وقال الكرمانى فيسلمها الى اربابها وعمالها من الملائكة ليلة السابع والعشرين من شهر رمضان.
অর্থ: “হযরত ইমাম বাগবী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন- হযরত আবু দ্বহা রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে হাদীছ শরীফ বর্ণিত আছে যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শা’বানের রাতে তথা শবে বরাতে যাবতীয় বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। আর ক্বদরের রাতে তথা শবে ক্বদরে সেই সিদ্ধান্তকে কার্যকরী তথা বাস্তবায়ন করার জন্য তালিকা পেশ করেন বাস্তবায়নকারী ফেরেশতাদের হাতে। হযরত ইমাম কিরমানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, পূর্ব সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্য বাস্তবায়নকারী ফেরেশতা উনাদের হাতে যেই রাত্রিতে তালিকা পেশ করা হয়, সেই রাত্রিটি হচ্ছে রমাদ্বান মাসের ২৭ তারিখের রাত। (তাফসীরে নাযমুদ দুরার ৭ম খ-ের ৬৪ পৃষ্ঠা)
এ প্রসঙ্গে সূরা ক্বদরের তাফসীরে ‘তাফসীরে কুরতুবী’-এর ২০তম জুযে ১৩০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
وعن ابن عباس رضى الله تعالى عنه ايضا ان الله تعالى يقضى الاقضية فى ليلة النصف من شعبان ويسلمها الى اربابها فى ليلة القدر.
অর্থ: “প্রখ্যাত ছাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত আছে যে, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শা’বান তথা ১৫ই শা’বানের রাত্রিতে অর্থাৎ শবে বরাতে যাবতীয় বিষয়ের ভাগ্য তালিকা প্রস্তুত করেন। আর ক্বদরের রাত্রিতে ওই ভাগ্যতালিকা পেশ করেন বাস্তবায়নকারী ফেরেশতাদের হাতে।
কাজেই উক্ত আলোচনা থেকে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠলো যে, শবে বরাত বান্দাদের তালিকা প্রস্তুত করা হয় আর শবে ক্বদরে সেই ভাগ্যতালিকা জারি বা কার্যকরী করা হয়।
সূতরাং  এটাই প্রমানিত হলো যে, লাইলাতুম মুবারাকা দ্বারা ভাগ্য নির্ধারণ রজনী বা শবে বরাতকে বুঝানো হয়েছে।
পরবর্তী পর্বে বিভিন্ন তাফসীর থেকে সূরা আদ দুখানের তাফসীর উল্লেখ করা হবে। ইনশা আল্লাহ।