Loading...

হলুদ মিডিয়ার সৃষ্টি ‘পান্তা -ইলিশ’ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ কিবাংলাদেশের শেকড়ের সংস্কৃতি?

এক শ্রেণীর সুবিধাভোগী এবং শিক্ষিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব পহেলা বৈশাখের পান্তা ইলিশ এবং মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে হৈচৈ শুরু করেছে। পহেলা বৈশাখেই পান্তা ইলিশ আর মঙ্গল শোভাযাত্রা যেন এ অঞ্চলের সংস্কৃতির মূল। ব্যবসায়িক স্বার্থে ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়াগুলোতে পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা, পান্তা ইলিশকে বাংলাদেশের গ্রাম বাংলার মানুষের আদি সংস্কৃতি হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। বেসরকারি টিভি মিডিয়াগুলো ব্যবসায়িক ‘মওকা’ পেয়ে পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিয়ে ঘুম হারাম করেছে। নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
প্রশ্ন হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং পান্তা ইলিশ কী বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতি? কয়েক দিন থেকে পহেলা বৈশাখের পান্তা ইলিশ আর মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি নিয়ে টিভিতে যে ‘রগরগা বিজ্ঞাপন’ প্রচারের প্রতিযোগিতা চলছে তা কী বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের কৃষ্টি-কালচার-জীবনাচারের সঙ্গে যায়?
১.বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক গবেষক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ বাংলাদেশের সংস্কৃতি নয়। কয়েক বছর আগে ৫ টাকা দিয়ে একটি ইলিশ কেনার ক্ষমতা সাধারণ মধ্যবৃত্তের মানুষের ছিল না। কলকাতায় ব্যবসায়িক স্বার্থে পহেলা বৈশাখ দুই দিন পালন করা হয়। এখানেও সেই ব্যবসায়িক স্বার্থই হচ্ছে। দে

২.শহরের কিছু শিক্ষিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষার্থী এবং তথাকথিত প্রগতিশীলরা (এদের সঙ্গে গ্রামের মানুষের সম্পর্ক নেই) প্রচার করছে পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। রমনার বটমূল থেকে শুরু করে রাজধানীর রাস্তা-ঘাটে, পার্কে, রেস্তোরাঁয় বিক্রি হবে মাটির সানকিতে পান্তা ভাত আর ইলিশ মাছ। শখ করে ধনী, মধ্যবিত্ত সবাই ভাজা ইলিশের গন্ধে পান্তার স্বাদ নিবে।

৩.পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য প্রায় এক মাস থেকে চারুকলার ছাত্রছাত্রীরা দিন রাত খাটুনি করে সরঞ্জাম তৈরি করছে। বিভিন্ন পশু-পাখি ও মুখোশ তৈরি করছে। পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলসহ শাহবাগের আশপাশে বিভিন্ন গানের আসর বসানোর প্রস্তুতি চলছে। বেসরকারি টিভিগুলোতে এ সব সরাসরি প্রচারও করা হয়। প্রশ্ন হলো এগুলো কী বাংলাদেশের গ্রাম বাংলার প্রাচীন বা আদি সংস্কৃতি? আশির দশকের আগেও রাজধানীতে এসব দেখা যায়নি।
৪.প্রবাদে রয়েছে ‘উর্বর মস্তিস্ক শয়তানের আড্ডাখানা’। আশির দশকে হঠাৎ করেই এই পান্তা ইলিশ, মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রচলন শুরু হয়।
৫.খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৮৪ সালের ১৪ এপ্রিল কর্মহীন কিছু ব্যক্তি পহেলা বৈশাখে এক বেকারকে কিছু উপার্জনের জন্য রমনা পার্কে পান্তা ভাতের দোকান দেয়ার পরামর্শ দেয়। সে মতে ফুটপাতের জনৈক বেকার পান্তা ভাত, ইলিশ মাছ ও বেগুন ভর্তা নিয়ে ঢাকার রমনা বটমূলে খোলা উদ্যানে দোকান দেয়। প্রচন্ড- গরমে পার্কে ঘুরতে আসা মানুষ সে দোকানে এসে সেই পান্তা-ইলিশ ভাজা এবং ভর্তা নিয়ে ফুটপাতের লোকজনের মতো দুবলা ঘাসের উপর বসেই খায়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পান্তা শেষ। অতপর দুপুরের রোদে পার্কে ঘুরতে আসা মানুষ পান্তা না পেয়ে পাশের স্টলে থাকা চটপটি, ফুচকা, সিঙ্গারা সমুচা, আইসক্রিম ইত্যাদি খেয়ে ঘুরাফেরা করে। তখন থেকে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে রমনা পার্কে পান্তা ইলিশের আয়োজন করা হয়। এই হলো পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশের ইতিহাস।
৬.ষাটের দশকে এ দেশের কিছু কবি-সাহিত্যিক-অধ্যাপক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের পরামর্শে পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ করেছিল। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারীর প্রতিবাদে ১৯৬৫ সাল (১৩৭৫ বঙ্গাব্দে) ছায়ানট নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণ উৎসব পালনের আয়োজন করে। রবীন্দ্র সংগীত ‘এসো হে বৈশাখ... এসো, এসো...’ গানের মাধ্যমে তারা স্বাগত জানায় নতুন বছরকে। অতঃপর প্রায় প্রতিবছর বর্ষবরণ করে সংগঠনটি পরিচিতি লাভ করে। ১৯৭২ সালের পর থেকে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ ‘জাতীয় উৎসবের’ স্বীকৃতি পায়। ১৯৮৯ সালে তথাকথিত কিছু শিক্ষিত প্রগতিশীল কলকাতার স্টাইলে ঢাকায় বৈশাখী ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ যোগ করে বাংলা বর্ষবরণে।
৭.জানা যায় ১৯৮৯ সালে এই শোভাযাত্রার প্রচলন শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থীরা। পহেলা বৈশাখের দিন সকাল গড়িয়ে যখন রমনা-টি.এস.সি-শাহবাগে মানুষের উপচে পরা ভিড় থাকে, তখন শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে শোভাযাত্রা বের হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এখানে পশু পাখির মুখাকৃতির ছবিসহ বিভিন্ন অনুসঙ্গ ফুটিয়ে তোলা হয় নানা রং বেরং-এর মুখোশ ও আলপনার মাধ্যমে। হালে বেসরকারি টিভি মিডিয়ার প্রসার ঘটনায় অনেক মিডিয়া ব্যবসায়িক লাভের জন্য বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন নিয়ে এসব অনুষ্ঠান সরাসরি প্রচার করে।
৮.টিভির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সরাসরি অনুষ্ঠান প্রচারের প্রতিযোগিতা চলছে। কোনো কোনো বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঢাকায় যায়গা না পেয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে গান-বাজনার আয়োজন করে যা মিডিয়ায় সরাসরি প্রচার করা হয়। এই হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা আর পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশের সংস্কৃতির জন্মকথা।
৯.ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, ১৯৬৭ সালের আগে পহেলা বৈশাখ পালিত হয়নি। তাহলে পহেলা বৈশাখে মাটির সানকিতে পান্তা ইলিশ খাওয়াকে বাংলাদেশের মানুষের আদি সংস্কৃতি হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে কেন? বাংলা ভাষার গবেষকদের মতে, বাংলাদেশের সংস্কৃতি হাজার বছরের পুরনো। ৩০/৩৫ বছর আগে শুরু হওয়া কিছু শিক্ষিত লোকের পান্তা ইলিশ খাওয়া আদি সংস্কৃতি হয় কেমন করে?