=================================================
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে কী ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ছিল:
একশ্রেণীর লোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে ধর্মনিরপেক্ষতা, ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়ের সাথে সম্পর্কহীনতা বুঝাতে চায়। অথচ ৭২’ সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যান্য দেশের কথিত ধর্মনিরপেক্ষতার মতো নয়। এটা বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব দর্শন। তিনি বলেছেন, “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।” বরং যার যার ধর্মের কথা বলাই বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা। সে জন্যই আ’লীগের নির্বাচনী প্রচারণা, বক্তৃতা-বিবৃতিতে ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন বিষয়গুলো বারবার এসেছে। মদীনা সনদের কথা এসেছে। শুধু তাই নয়, খোদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিই ছিল পবিত্র দ্বীন ইসলাম।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচীর মুলনীতি হিসাবে সর্বাগ্রে ঘোষণা করা হয়: “কোরআন-সুন্নাহর মৌলিক নীতির খেলাফ কোনো আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামী সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবনধারণের ব্যবস্থা করা হইবে।” (দ্রষ্টব্য: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, ১ম খন্ড, ৩৭০ পৃ.)
১৯৬৯ সালের আইয়ুব বিরোধী ছাত্র-গণ আন্দোলনের ছাত্র সমাজের ১১ দফা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উক্ত ১১ দফায় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকলেও “ধর্মনিরপেক্ষতার” কথা কোথাও বলা হয়নি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের পক্ষ হতে পরিষ্কার ঘোষণা দেয়া হয় যে “কুরআন সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন পাস করা হবে না।” নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করার পর তাদের সংবিধান কমিটি কর্তৃক প্রণীত খসড়া সংবিধানের প্রস্তাবনায় তদানীন্তন “পাকিস্তানের মুসলমানদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে গড়ে তোলার” কথা স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছিলো। (দ্রষ্টব্য: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, ২য় খন্ড,সংযোজন ১, পৃ.৭৯৩)
সেই খসড়া সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সন্নিবেশিত হয়েছিল:
“(১) কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন পাস করা হবে না,
(২) কোরআন ও ইসলামিয়াত শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে,
(৩) মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী নৈতিকতা উন্নয়নের পদক্ষেপ নেয়া হবে।” (দ্রষ্টব্য: ঐ,২য় খন্ড,পৃ.৭৯৪)
বক্তারা বলেন, কাজেই এ কথা সুস্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগের জন্ম হতে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জনগণের সামনে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার কোনো রাষ্ট্র গঠনের কোনো প্রস্তাব বা কর্মসুচী পেশ করা হয়নি। বরং বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন ভাষায় জনগণকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর কুশাসন ও আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন মূলত ইসলামের বিপক্ষে কিছু নয় এবং ক্ষমতায় গেলে ‘কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন পাস করা হবে না’। কুরআন-সুন্নাহর আলোকে জনগণের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেয়া হবে। জনগণ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টকে, ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির আশায়, আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণ এবং কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন পাস করা হবে না- এই ওয়াদার কারণে। জনগণ কোনোক্রমেই ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য ভোট দেয়নি।
স্বাধীনতার গোড়ার দিকে কি কথা বলে, কোনো চেতনাকে উজ্জ্বীবিত করে দেশের সাধারণ জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিলো তার উৎকৃষ্ট নজির মিলে ১৯৭১-এর ১৪ এপ্রিল অর্থাৎ আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার মাত্র চারদিন পর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের প্রতি যে নির্দেশাবলী প্রদান করা হয় তার মধ্যে।
নির্দেশাবলীপত্রের শীর্ষেই “আল্লাহু আকবার” লিখা হয়। তারপর স্বাধীনতার প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করে বলা হয়, “বাঙালির অপরাধ তারা অবিচারের অবসান চেয়েছে, বাঙালির অপরাধ তারা তাদের মা-বাপ, ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততিদের জন্যে অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসার দাবী জানিয়েছে, বাঙালির অপরাধ- আল্লাহর সৃষ্ট পৃথিবীতে, আল্লাহর নির্দেশমত সম্মানের সাথে শান্তিতে সুখে বাস করতে চেয়েছে। বাঙালির অপরাধ- মহান স্রষ্টার নির্দেশমত অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে এক সুন্দর ও সুখী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলবার সংকল্প ঘোষণা করেছে। আমাদের সহায় পরম করুণাময় সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাহায্য। মনে রাখবেন- আপনার এ সংগ্রাম ন্যায়ের সংগ্রাম, সত্যের সংগ্রাম। পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার দুশমনরা বাঙালি মুসলমান নারী-পুরুষ, বালক-বালিকা কাউকে হত্যা করতে, বাড়ি-ঘর লুট করতে, আগুন জ্বালিয়ে দিতে এতটুকু দ্বিধা করেনি। মসজিদে-মিনারে আজান প্রদানকারী মুয়াজ্জিন, মসজিদ গৃহে নামাযরত মুসল্লী, দরগাহ-মাজারে আশ্রয়প্রার্থীরাও হানাদারদের গুলি থেকে বাঁচেনি। এ সংগ্রাম আমাদের বাঁচার সংগ্রাম। সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ন্যায়ের সংগ্রামে অটল থাকুন। স্মরণ করুন: আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, “অতীতের চাইতে ভবিষ্যৎ নিশ্চয় সুখকর।” বিশ্বাস রাখুন- “আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী।” (দ্রষ্টব্য: ঐ ৩য় খন্ড, পৃ.১৯-২২)
১৯৬৯ সালে ১লা আগস্ট আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল তাতে রাষ্ট্রীয় আদর্শের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। ইসলাম, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বা সমাজতন্ত্র কোনো কিছুরই প্রসঙ্গ তাতে ছিল না। ৬ দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তান গড়ার অঙ্গীকারই ছিল মুখ্য। সে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তারা পাকিস্তানের জন্য একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে। এই সংবিধানের Preamble শুরু হয় In the name of Allah, the Beneficial, Merciful… দিয়ে। এই প্রস্তাবিত সংবিধানের ৭ম অনুচ্ছেদের বলা হয়Ñ Further resolving that guarantees shall be embodied in this constitution to enable the people of Pakistan, Muslim, Hindu, Buddhist, Christian, Persian and of other religions to profess and practice their religions and to enjoy all rights, privileges and protection due to them as citizen of Pakistan and in pursuance of this object to enable the Muslims of Pakistan, individually and collectively, to order their lives in accordance with the teachings of Islam as set in the Holy Qur’an and the Sunnah.(আওয়ামী লীগ সংবিধান কমিটি কর্তৃক ৬ দফার ভিত্তিতে প্রণীত পাকিস্তানের খসড়া শাসনতন্ত্র (অংশ) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, ঢাকা, ১৯৮২, পৃষ্ঠা ৭৯৩)। অর্থাৎ প্রস্তাবিত এই সংবিধানে সকল নাগরিকের ধর্র্মীয় স্বাধীনতার কথা বলা হয়। কিন্তু আদর্শ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বা সমাজতন্ত্রের কোনো উল্লেখ মাত্র ছিল না। বরং মুসলমানরা যাতে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে পারে তার ব্যবস্থার কথা সুস্পষ্টরূপে বলা হয়। বলা বাহুল্য, পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে এই সংবিধানই কার্যকর হতো।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। কে কখন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এ নিয়ে বিতর্ক আছে। শেখ মুজিবুর রহমান বা জিয়াউর রহমান যেই তা করে থাকুন, তারা কেউই তাদের সে ঘোষণায় বলেননি স্বাধীন বাংলাদেশের মূলনীতি কী হবে। শেখ মুজিব তার ঘোষণা ‘জয় বাংলা’ বলে শেষ করার আগে বলেন, May Allah bless you (দেখুন আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইট)।
১৯৭১ সালে ২৫ শে মার্চের পর আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং পাকিস্তান গণপরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাাচিত বেশির ভাগ সদস্য ভারতে আশ্রয় নেন। তারা ১০ এপ্রিল কলকাতায় সমবেত হয়ে একটি প্রবাসী আইন পরিষদ গঠন ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করেন। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথতলায় (পরবর্তী নাম মুজিবনগর) এটি আনুষ্ঠানিকভাবে জনসমক্ষে পাঠ করা হয়। এই ঘোষণার মাধ্যমে নবগঠিত আইন পরিষদ ২৬ শে মার্চ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কার্যকর বলে ঘোষণা করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই ঘোষণাপত্র প্রবাসী সরকার পরিচাালনার অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান হিসেবে গৃহীত হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সংবিধান প্রণীত হওয়া পর্যন্ত কার্যকর ছিল।
এই ঘোষণাপত্রে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়, ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর এবং ১৯৭১ সালে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল। জনগণ আওয়ামী লীগের ১৬৭ জনকে নির্বাচিত করে। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করে। এ অবস্থায় জনপ্রতিনিধিদের পক্ষে একত্র হয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়নপূর্বক জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সে জন্য পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাকে অনুমোদন করা হয়। একই সঙ্গে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের নামে স্বাধীন বাংলা করার আইনের ধারবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ ১৯৭১ জারি করে। এতে বলা হয় : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে সকল আইন চালু ছিল, তা ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একইভাবে চালু থাকবে, তবে প্রয়োজনীয় সংশোধনী সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের জন্য করা যাবে। (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, ঢাকা, ১৯৮২, পৃষ্ঠা ৪-৬)
১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের প্রচার দফতর একটি সার্কুলার জারি করে। সেটি শুরু হয় আল্লাহু আকবার দিয়ে, আর জয় বাংলা বলে শেষ করার আগে লেখা হয় : স্মরণ করুন আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অতীতের চাইতে ভবিষ্যৎ নিশ্চয়ই সুখকর। বিশ্বাস করুন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী।
১৯৭১ সালের ২০ মে হিন্দুস্তান টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এইচ এম কামারুজ্জামান বলেন, Our struggle is not opposed to Islam. The value and teachings of Islam shall be preserved. (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ও দলিলপত্র, গতিধারা, ঢাকা : পৃষ্ঠা ৪৫)
ওপরের আলোচনা ও তথ্য থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা ছিল গণতন্ত্র ও ধর্র্মীয় মূল্যবোধে উজ্জীবিত, স্বাধীন ও সার্বভৌম, বৈষম্য ও শোষণহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করা। এই কথাই বলা হয়েছে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মেনিফেস্টো, ১৯৭০ সালের আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টো ও প্রস্তাবিত সংবিধান এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে।
১৯৭০ এর নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে একথাই ছিল– “সংখ্যাগুরু জনগণ ইসলামে গভীরভাবে বিশ্বাস করে। সুতরাং পবিত্র কুরআন এবং সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক হয় এমন কোন আইন কিংবা বিধান আওয়ামী লীগ প্রবর্তন করবে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পবিত্রতা সাংবিধানিকভাবে অক্ষুণ্ণ থাকবে”। [দেখুনঃ Bangladesh Documents, page- 67, 68] ১৯৭০ এর এই নির্বাচনের উপর ১৯৭১ এ স্বাধীনতা আন্দোলন হয়। তাহলে বুঝা যায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এই মূলনীতির উপর হয়েছে যে, এদেশের অধিকাংশ মানুষ গভীরভাবে ইসলামে বিশ্বাস করে সুতরাং কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন, কোন কার্যক্রম এই দেশে পাশ হবে না। এটা হচ্ছে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি।
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আওয়মী লীগ সংবিধান কমিটি ৬ দফা ভিত্তিক যে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করেছিল, তাতে যে নির্দেশমূলক রাষ্ট্রীয় মূলনীতি প্রণীত হয়েছিল তাতে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা তো ছিলই না, বরং ইসলাম ও মুসলমানদের কথাই সোচ্চার হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র ২য় খণ্ডের ৭৯৩ পৃষ্ঠায় বিষয়টি এভাবে উল্লেখ রয়েছে-
‘ক. ৩য় ভাগ- নির্দেশমূলক রাষ্ট্রীয় মূলনীতি-
১. ইসলাম
২. পবিত্র কুরআন এবং সুন্নাহর আজ্ঞাসমূহের খেলাফ কোনো আইন প্রণয়ন করা হবে না।
৩. পাকিস্তানের মুসলমানদের পবিত্র কুরআন ও ইসলামিয়াত শিক্ষার সর্ব সুযোগ প্রদান করতে হবে।
৪. পাকিস্তানের মুসলমানদের ধর্মীয় কর্মগুলো পালনে নৈতিকমান উন্নয়ন সাধন করতে হবে।’
১৪ এপ্রিল, ১৯৭১। প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের প্রতি নির্দেশাবলি প্রদান করা হয়। এই নির্দেশনাপত্রের শীর্ষেই লিখা হয় ‘আল্লাহ আকবর’। সে নির্দেশনামায় স্বাধীনতার প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করে বলা হয়, “বাঙালির অপরাধ তারা অবিচারের অবসান চেয়েছে, বাঙালির অপরাধ তারা তাদের মা-বাপ, ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততির জন্য অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসার দাবি জানিয়েছে, বাঙালির অপরাধ আল্লাহতায়ালার সৃষ্ট পৃথিবীতে, আল্লাহর নির্দেশমতো অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে এক সুন্দর ও সুখী সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলবার সংকল্প ঘোষণা করেছে। …. আমাদের সহায় করুণাময় সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাহায্য। মনে রাখবেন, আপনার এ সংগ্রাম ন্যায়ের সংগ্রাম, সত্যের সংগ্রাম। পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার দুশমন বাঙালি মুসলমান নারী-পুরুষ, বালক-বালিকা কাউকে হত্যা করতে, বাড়িঘর লুট করতে, আগুন জ্বালিয়ে দিতে এতটুকু দ্বিধা করেনি। মসজিদ-মিনারে আজান প্রদানকারী মুয়াজ্জেন, মসজিদ গৃহে নামাজরত মুসল্লি, দরগাহ-মাজারে আশ্রয়প্রার্থী হানাদারদের গুলি থেকে বাঁচেনি। … এ সংগ্রাম আমাদের বাঁচার সংগ্রাম। সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখে ন্যায়ের সংগ্রামে অটল থাকুন। স্মরণ করুন : আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘অতীতের চাইতে ভবিষ্যৎ নিশ্চয়ই সুখকর।’ বিশ্বাস রাখুন ‘আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী’।”(দ্রষ্টব্য : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, ১৯৮২, তৃতীয় খণ্ড, স্বাধীনতার লক্ষ্য পৃ.১৯-২২)
আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘শেখ বোরহান উদ্দিন কোথা থেকে কিভাবে এই মধুমতীর তীরে এসে বসবাস করেছিলেন কেউই তা বলতে পারে না।’ (পৃষ্ঠা-৩)। ‘ইংরেজরা মুসলমানদের ভাল চোখে দেখত না।’ (পৃ : ৫)। ‘মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেনুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম, আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না ও রেনুর বয়স তখন বোধ হয় তিন বছর হবে।’ (পৃ : ৭)। ‘১৯৪১ সাল : তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি। খেলার দিকে আর নজর নাই। শুধু মুসলিম লীগ, আর ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নাই।’ (পৃ: ১৫)। ‘মুসলিম লীগ বললেই গোপালগঞ্জে আমাকে বোঝাত। ‘(পৃ : ১৫)। ১৯৪১ বা ১৯৪২ সালে চুঁচুঁড়া সম্মেলনে… আমি ও আমার সহকর্মীরা ফজলুল কাদের চৌধুরীর (ছাত্র) দলকে সমর্থন করে বের হয়ে এলাম।’ (পৃ: ১৬)। ‘আমরাও কলকাতা (মুসলিম লীগ) অফিসের হোলটাইম ওয়ার্কার হয়ে যাই। যদিও (ইসলামিয়া কলেজ) হোস্টেলে আমার রুম থাকত, তবু আমরা প্রায়ই লীগ অফিসে কাটাতাম। …পাকিস্তান না আনতে পারলে লেখাপড়া শিখে কি করব?’ (পৃ: ৩২)। ‘অখণ্ড ভারতে যে, মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না এটা আমি মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম। (পৃ: ৩৬)। ‘এখন আর মুসলমান ছেলেদের মধ্যে মতবিরোধ নাই। পাকিস্তান আনতে হবে, এই একটাই স্লোগান সকল জায়গায়।’ (পৃ: ৩৬)। ‘আমি প্রায় সকল সময়ই ‘পাকিস্তান, পাকিস্তান’ করে বেড়াই। ইসলামিয়া কলেজের সকল ছাত্রই মুসলমান।’ (পৃ: ৩৭)।
এবার বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধা-সংগঠক, প্রবীন রাজনীতিবীদ, প্রখ্যাত আইনজীবী এডভোকেট বদিউল আলমের লেখা থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করব। তার আগে তাঁকে আরেকটু পরিচয় করিয়ে দিই। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক চট্টগ্রাম জেলা সহ-সভাপতি। তাঁকে অনেকেই আওয়ামী লীগের দুর্দিনের বন্ধু হিসেবে চিত্রায়িত করেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিয়েতে ঢাকায় কোন অনুষ্ঠান না হওয়ায় চট্টগ্রাম রাইফেল ক্লাবে নব দম্পতিকে সম্বর্ধনা দেবার জন্য এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। এতে যে অর্থ ব্যয় হয় তার আংশিক তিনি বহন করেছিলেন। বেগম শেখ একাকী বড় পুত্রকে নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। শেখ সাহেব বন্দী থাকায় বেগম সাহেবা অঝোরে কাঁদতে থাকেন। তাঁকে সান্ত্বনা দেবার জন্য তিনি সস্ত্রীক গিয়েছিলেন। এবার তাঁর জবানি পড়ি-
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণের তাৎপর্যপূর্ণ উচ্চারণ ছিল পাক কোরানের ‘ইনশাআল্লাহ’। তিনি স্বাভাবিকভাবে ভাষণের সময় উদ্বেগপূর্ণ ও আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলেন। তেজোদীপ্ত সংকল্প ও শপথ নিতে গিয়ে তিনি পরম করুণাময় আল্লাহতালার গায়েবি মদদ চেয়েছিলেন। শেখ সাহেব বিশ্বাসীদের একজন ছিলেন। একজন মুসলিম হিসাবে তিনি সংগতভাবেই দেশকে মুক্ত ও সবাধীন করার সংগ্রামে ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।
এই দুরূহ ও কঠিন কার্য্য সম্পাদনের শক্তি ও সাহসের চালিকাশক্তি ছিল একমাত্র এলাহি ভরসা। শেখ সাহেবের পক্ষে ছিল দুর্জয় প্রতিরোধে উদ্দীপ্ত নিরস্ত্র বিশাল জনতা। ঈমানি শক্তিতে বলীয়ান না হলে তখনকার দিনের বিপদসংকুল অবস্থার মোকাবেলা মোটেই সহজসাধ্য ছিল না।
‘দেশ মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ’ অর্থ আল্লাহ চাহেনত দেশ মুক্ত ও স্বাধীন করে ছাড়ব। এতে আল্লাহর ইচ্ছা অনিচ্ছার কথাই ব্যক্ত হয়েছে। আল্লাহতালা চাইলে দেশ মুক্ত হবে, নয়ত হবে না। আল্লাহতালার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, চাওয়া-না চাওয়ার উপর অবিচল বিশ্বাস নিয়ে দেশবাসীর জয় কামনায় বিধাতার সাহায্য চেয়েছেন। (মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার মূল্যবোধ- এডভোকেট বদিউল আলম, পৃষ্ঠা- ৮০-৮১)
ধর্মনিরপেক্ষতা যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল না, তার প্রমাণ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের ৯নং সেক্টরের প্রধান মেজর (অব.) এম এ জলিলের ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা’ নামক বই থেকে উদ্ধৃত করছি- ‘সত্তরের শেষ এবং একাত্তরের শুরুর সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামী জনগণের মাঝে বিজাতীয়দের চরম ঘৃণা বিদ্বেষ পরিলক্ষিত হলেও ইসলাম ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ মোটেও পরিলক্ষিত হয়নি, অথবা ধর্মহীনতা আমাদের পেয়ে বসেনি। তৎকালীন সময়ে কট্টর আওয়ামী লীগার বলে পরিচিত নেতা-কর্মীদের মুখে ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ নাম গন্ধও শুনতে পাইনি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দামাল তরুণ-যুবকদের অধিকাংশই ছিল এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সন্তান-সন্ততি। যুদ্ধের রক্তাক্ত ময়দানেও আমি মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেছি বাকায়দা নামায পড়তে, দরূদ পাঠ করতে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শাসককুল পবিত্র ইসলাম ধর্মকে বিভিন্ন সময়ে তাদের হীন স্বার্থে ব্যবহার করেছে বিধায় তাদের বিরুদ্ধে সচেতন জনগণ সোচ্চার ছিল বটে, তবে প্রকাশ্যে পবিত্র ইসলাম ধর্মের প্রতি কোন মহলই ঘৃণা কিংবা বিদ্বেষ প্রদর্শন করেনি। ইসলাম ধর্মের বিষয়টি আমি এখানে এ কারণে উল্লেখ করেছি যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধের পরের ইসলাম- এর মধ্যে হঠাৎ করে এমন কি ঘটে গেল যাতে ইসলামের কথা শুনলেই কোন কোন মহল পাগলা কুকুরের মত খিঁচিয়ে উঠেন। যে দেশের শতকরা নব্বই জনেরও অধিক পবিত্র ইসলাম ধর্মের অনুসারী, সে দেশে এ করুণ উন্মাদনার মধ্য দিয়ে ধর্মের নিকুচি করা কি আদৌ যুক্তিসম্মত? (পৃ. ২২-২৩)
মাওলানা ইসহাক ওবাইদী তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কস্মিনকালেও ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র ছিলো না। এটা ভারত-রাশিয়ার চালে সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছে, সংবিধান রচয়িতা ড. কামাল হোসেন ভাল বলতে পারবেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় বা তার আগে এই দুই মূলনীতি কোথাও ঘোষিত হয়েছিলো কিনা? আওয়ামী লীগের ৬ দফায় তা ছিলো না, ছাত্রদের ১১ দফায়ও তা ছিলো না এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ৯০/৯৫ ভাগ মানুষই ছিলো মুসলমান, তাও তারা সবাই আওয়ামীলীগও ছিলো না। আওয়ামীলীগের ডাকে সাড়া দিয়ে সমগ্র দেশ-জনতা যুদ্ধ করেছে পাক বাহিনীর যুলুমের বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে নয়।’ একই প্রবন্ধে একটু পরেই তিনি লিখেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, যদি কেউ এই দুই মূলনীতি অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র কোথাও ছিলো বলে দেখাতে পারে তাহলে আমি যে কোন শাস্তি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত আছি।’ (মাসিক নেয়ামত, মার্চ ২০১৫)
বামপন্থী মহলের চিন্তাপুরুষ ও শক্তিমান লেখক মরহুম আহমদ ছফাও এই স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হয়েছেন- “বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠার পেছনে ভাষা যেমন তেমনি ধর্মও [ইসলাম] একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ক্রিয়াশীল থেকেছে। এগুলো সত্য।” (প্রনন্ধ সমগ্র- আহমদ ছফা, ৩য় খণ্ড পৃ. ১১৯)
Home
ইসলাম ও স্বাধীন বাংলাদেশ
খোদ বঙ্গবন্ধু ইসলামের চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন এবং দেশের স্বাধীনতা অানয়ন করেন।