পুর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে বিবেচনার জন্য শামসুল হক ‘মূল দাবি’ নামে একটি ছাপা পুস্তিকাতে লিপিবদ্ধ তাঁর বক্তব্য পাঠ করেন।পুস্তিকাটির মুখবন্ধের প্রারম্ভে তিনি বলেন;১৯৪৯ সনের ২৩ ও ২৪ শে জুন তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘পুর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন’ মনে করে যে, সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বদেশের যুগ প্রবর্তক ঘটনাবলীর ন্যায় লাহোর প্রস্তাবও একটা নতুন ইতিহাসের সৃষ্টি করিয়াছে।বিরুদ্ধ পরিবেশে মানবের দেহ, মন ও মস্তিষ্কের উন্নতি ও পুর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়।মানুষ পরিবেশের দাস একথা আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণও স্বীকার করেন।বিরুদ্ধ পরিবেশে পুর্ণ ইসলামিক মনোভাব এবং সমাজ বিধান গড়িয়া তোলা সম্ভব নয়।ভারতের মুসলমানগণ বহু শতাব্দীর সঞ্চিত অভিজ্ঞতা হইতে এই মহা সত্য উপলব্ধি করিয়াই বিরুদ্ধ পরিবেশে বা দারুল হরবের পরিবর্তে ইসলামিক পরিবেশ বা দারুল ইসলাম কায়েম করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছিল।
কিন্তু পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র হইলেও শুধু মুসলমানের রাষ্ট্র যা শুধু মুসলমানের জন্য প্রতিষ্ঠিত করিবার এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা ও শিক্ষা প্রতিভাবান্বিত ইসলামীবিরোধী সাম্রাজ্যবাদী ও ধনতান্ত্রিক ও আত্মকেন্দ্রিক পরিবেশ গড়িয়া তুলিবার ইচ্ছা তাহাদের ছিল না।
রব বা স্রষ্টা হিসাবেই সৃষ্টির বিশেষ করিয়া সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের সাথে আল্লাহর সবচাইতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।বস্তুতঃ রব বা স্রষ্টা, পালন বা পোষণকর্তা হিসাবে, বিশ্ব ও সৃষ্টিকে ধাপের পর ধাপ, স্তরের পর স্তর, পরিবর্তনের পর পরিবর্তনের ভিতর দিয়া কতকগুলি স্থায়ী ও সাধারণ ক্রমবিকাশ ক্রমোন্নতির নিয়মানুসারে এক অবস্থা হইতে অপর অবস্থার ভিতর দিয়া ধীরে ধীরে কিন্তু সুনিশ্চিরুপে চরম সুখ, শান্তি ও পুর্ণতা প্রাপ্তির দিকে আগাইয়া নিবেন।
ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গীতে আল্লাহ শুধু মুসলমানের নয়-জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানবের।রবই আল্লাহ্র সত্যিকার পরিচয়।রব হিসাবে রবুবিয়াত বা বিশ্ব-পালনই তাঁর প্রথম ও প্রধান কাজ।সুতরাং দুনিয়ার উপর আল্লাহ খলিফা বা প্রতিভূ হিসাবে মানব এবং খেলাফত হিসাবে রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান কাজ ও কর্তব্য হইল আল্লাহ্র উপায় ও পদ্ধতি অনুসারে বিশ্বের পালন করা এবং জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের সামগ্রিক সুখ, শান্তি, উন্নতি, কল্যাণ ও পুর্ণ বিকাশের জন্য চেষ্টা, সাধনা ও সংগ্রাম করা"।
মুসলিম লীগ সম্পর্কে শামসুল হক পুস্তিকাটিতে বলেন;নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কখনও দল বিশেষের প্রতিষ্ঠান ছিলনা; ইহা ছিল ভারত উপমহাদেশের মুসলিম জনগনের জাতীয় প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চ।ইহার উদ্দেশ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর, পাকিস্তানের মূল নীতিগুলিকে কার্যকরী করিয়া তুলিতে হইলে প্রয়োজন নতুন চিন্তাধারা, নতুন নেতৃত্ব এবং নতুন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নীতি ও কর্মসুচী এবং মুসলিম লীগকে মুসলিম জনগণের সত্যিকার জাতীয় প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চ হিসাবে গড়িয়া তোলার।…..
কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমান পকেট লীগ নেতৃবৃন্দ উপরোক্ত কর্মপন্থা অনুসরণ না করিয়া তাঁদের নিজেদের কায়েমী স্বার্থ এবং প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব বজায় রাখার জন্য লীগের মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা ভাঙ্গাইয়া চলিয়াছেন।এই উদ্দেশ্যেই তাঁহারা মুসলিম লীগকে দল বিশেষের প্রতিষ্ঠান করিয়া ফেলিয়াছেন।
শুধু তাহাই নয় মানবের প্রতি আশীর্বাদস্বরুপ ইসলামকেও ব্যক্তি, দল ও শ্রেণী বিশেষের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অন্যায় এবং অসাধুভাবে কাজে লাগান হইতেছে।কোনও পাকিস্তানপ্রেমিক এমন কি মুসলিম লীগের ঝানু কর্মিগণ পর্যন্ত নীতি ও কর্মসুচী সম্পর্কে কোনরূপ প্রশ্ন উত্থাপন করিতে অথবা প্রস্তাব করিতে পারেনা। কেহ যদি এইরূপ করিবার চেষ্টা করে তাহা হইলে তাহাদিগকে পাকিস্তানের শত্রু বলিয়া আখ্যায়িত করা হয়।
পুর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন মনে করে যে, মুসলিম লীগকে এইসব স্বার্থান্বেষী মুষ্টিমেয় লোকদের পকেট হইতে বাহির করিয়া সত্যিকার জনগণের মুসলিম লীগ হিসাবে গড়িয়া তুলিতে হইলে, মুসলিম লীগকে সত্যিকার শক্তিশালী মুসলিম লীগ বা মুসলিম জামাত বা মুসলিম জাতীয় প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চে পরিণত করিতে হইলে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমকে ইহার সদস্য শ্রেণীভুক্ত করিতে হইবে।
অন্যথায় মুসলিম লীগকে পাশ্চাত্য সভ্যতা, গণতন্ত্র ও সাংগঠনিক নীতি প্রভাবান্বিত দলবিশেষের পার্টি বলিয়া ঘোষণা করিয়া অপরাপর সবাইকে সাধ্যমত দল গঠন করিবার সুযোগ, সুবিধা ও অধিকার দিতে হইবে।
মুসলিম লীগের ভিতর প্রত্যেক ব্যক্তি, দল ও উপদলের স্বাধীন মতামত, আদর্শ, নীতি ও কর্মসুচী ব্যক্ত এবং তাঁর পিছনে সংঘবদ্ধ হইবার অধিকার দিতে হবে।তদুপরি ছাত্র, যুবক, মহিলা, চাষী, ক্ষেতমজুর, মজদুর প্রভৃতি শ্রেণীসংঘ গড়িয়া তুলিবার স্বাধীনতা থাকিবে।
ইসলামী রাষ্ট্রের রূপ সম্পর্কে তাতে বলা হয়ঃ
১। পাকিস্তান খেলাফত অথবা ইউনিয়ন অব পাকিস্তান রিপাবলিকস বৃটিশ কমনওয়েলথের বাহিরে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্র হইবে।
২।পাকিস্তানের ইউনিটগুলিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের পুর্ণ অধিকার দিতে হইবে।
৩।রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব আল্লাহ্র প্রতিভূ হিসাবে জনগণের উপর ন্যস্ত থাকিবে
৪।গঠনতন্ত্র হইবে নীতিতে ইসলামী, গণতান্ত্রিক ও আকারে রিপাবলিকান।
এরপর কৃষি ও শিল্প নিয়ে বিস্তারিত প্রস্তাবনা ছিল ঐ মেনিফেস্টোতে……
……আমরা পুর্ববাংলার সরকারকে ধন্যবাদ দেই যে তাঁরা বাংলাকে পুর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করে বাংলা ভাষার দাবীকে আংশিকরূপে স্বীকার করেছেন। কিন্তু সরকারের ও জনসাধারণের এক বিপুল কর্তব্য সম্মুখে রয়েছে।……শিক্ষার মাধ্যম স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আগাগোড়া বাংলা করতে হবে।
ব্রিটিশ আমলের অনুমোদিত ওল্ড স্কীম, নিউ স্কীম ও সাধারণ-এই তিন বিভিন্ন ধারার শিক্ষা-পদ্ধতিকে একই সাধারণ ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হবে।ধর্মে যেমন আমরা একত্ববাদী, শিক্ষায়ও আমাদিগে একত্ববাদী হতে হবে।এজন্য নানা বিষয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি পরামর্শ সভার আশু প্রয়োজন হয়েছে।আযাদ পাকিস্তানে আমাদের অবিলম্বে শিক্ষা তালিকার সংস্কার করতে হবে।
এই নতুন তালিকায় রাষ্ট্র-ভাষা উর্দুকে স্থান দিতে হবে। যারা এতদিন রাজ-ভাষারূপে ইংরেজির চর্চা করেছে,তাদের উর্দু শিখতে কি আপত্তি থাকতে পারে? দেশের গণশিক্ষা, স্ত্রীশিক্ষা ও বয়স্কদের শিক্ষার বিস্তার করতে হবে।প্রাথমিক শিক্ষা, ধর্ম ও নীতি শিক্ষা এবং সামরিক শিক্ষাকে বাধ্যতামুলক করতে হবে।
আমাদিগে একটি একাডেমী (পরিষদ) গড়তে হবে, যার কর্তব্য হবে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য বিষয়ে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থাবলীর অনুবাদ বাংলায় প্রকাশ।এজন্য একটি পরিভাষা-সমিতির প্রয়োজন আছে।বিশেষ করে আরবী, পারসী এবং উর্দু ভাষা থেকে ইসলাম, ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে বইগুলির অনুবাদ একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।মখে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বললেই পাকিস্তান জীবিত থাকবেনা;তাকে ধর্মে ও জ্ঞানে, চরিত্রে ও দেহিক শক্তিকে উন্নত করে কৃষি ও শিল্পে, বানিজ্যে ও রণকৌশলে, সাহিত্যে ও কলায় মহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত করতে হবে।যে দিন সে দিন হবে, সে দিন আমরা দ্বিধামুক্ত অযুত কণ্ঠে বলতে পারব- পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
[ বদরুদ্দীন উমর, পুর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি থেকে উদৃত; আবু আল সাঈদ, আওয়ামী লীগের ইতিহাস ১৯৪৯-১৯৭১, সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৩, পৃঃ১৯৭-২০০]
বদুরুদ্দীন উমর তার বইতে আরো লিখেন;
‘আওয়ামী মুসলিম লিগের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সেখানকার অনেকেই এই নতুন সংগঠনটির সাথে যুক্ত না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।আওয়ামী লীগের সাম্প্রদায়িক চরিত্রই তাঁর প্রধান কারণ।সে সময় নেতৃস্থানীয় কর্মীরা এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে কমরুদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দিন আহমদ প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য (বদরুদ্দীন উমর, পুর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খন্ড), আনন্দধারা প্রকাশন, পৃঃ২৬৪)
উপরোক্ত কর্মিরা আওয়ামীলিগে যুক্ত না হবার অন্যতম আরেকটি কারণ ছিল এই তাঁরা ছিলেন আদতে ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টির কর্মি।